প্রশ্নটা দেখে খানিকটা জোর করেই লিখতে বসে পড়লাম। নাহ... লেখালেখি অথবা এই প্রশ্নটির প্রতি কোনও অনিচ্ছার কারণে নয়। আসলে কাজের চাপে অবসরের সময় বের করাটা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে যতো বয়স বাড়ে। আমারও তাই হয়েছে। ইদানিং এই কাজের চাপেই সিনেমা দেখা ব্যাপারটা অনেকটা কমাতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু, ভালো মুভির খবর যদি আমি পেয়ে থাকি অথবা কোনও সিনেমার ট্রেলর যদি আমার ভালো লেগে থাকে, তাহলে আমি যে করেই হোক সময় করে সেটা দেখবই। তার জন্য আমি মহামূল্যবান ঘণ্টা তিন-চারেকের ঘুমও ছাড়তে পারি। আর সেটাই করি। বইপড়া বাদে আমার ঝোঁক আর শখ বলতে, ওই দু’টো – একটা হলো সিনেমা দেখা, আরেকটা হলো রেসলিং আর এমএমএ শো এবং পে-পার-ভিউ দেখা। ব্যাস আর আমার কিছু চাই না বিনোদনের জন্য। মোদ্দা কথা কাজের ফাঁকে মগজ ঠাণ্ডা করার জন্য ওটা আমার টোটকা।
আমি সব ধরনের মুভিই দেখি। ফ্যান্টাসি, হরোর, কমেডি, রোমান্টিক, থ্রিলার, অ্যাকশন, সাই-ফাই, হিস্টোরিকাল, অ্যাডভেঞ্চার - এসবের মধ্য থেকে যদি সিনেমার জঁর বেছে কেউ বলতে বলেন, তাহলে বলব সাই-ফাই আর অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার আমার অল-টাইম ফেবারিট। জীবনে আমি অনেক সিনেমা দেখেছি। হাত গুনে, আন্দাজে তার সংখ্যা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক সময় সিনেমার নাম শুনে গল্প মনে করতে না পারলেও, দেখতে বসলে পাঁচ মিনিট বাদেই বলে দিতে পারব, সেটা দেখেছি, কি দেখিনি – দেখা থাকলে ওই সিনেমার গল্প তখন আমার মাথায় চড়াৎ করে স্মৃতিশক্তির পিছনের দেরাজ থেকে সামনে চলে আসে।
সাই-ফাই আর অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার মুভি যেহেতু আমার অলটাইম ফেবারিট, সেই হিসেবে আমার দেখা সর্বকালের সেরা সিনেমা বা সিনেমার তালিকাটাও সেই রকমভাবেই হয়েছে। প্রশ্নটায় শুধুমাত্র সবচেয়ে পছন্দের সিনেমাটির কথা বলতে বলা হলেও, আমি আমার পছন্দের সেরা তিনটি সিনেমার কথা উল্লেখ করব। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো – তিনটি ছবিই হলিউডের।
দ্য টাইম মেশিন (২০০২):
প্রিন্স অফ পার্সিয়া (২০১০):
আমার দেখা সেরা তিনটি ছবির মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া এইচ. জি. ওয়েলসের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি গাই পিয়ার্স অভিনীত সাই-ফাই ও অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার মুভি ‘দ্য টাইম মেশিন’ ছবিটি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ২০১০ সালে সিলভার স্ক্রিনে জায়গা করে নেওয়া জ্যাক জিলেনহল ও জেমা অ্যাটারটন অভিনীত অ্যাকশন-অ্যাডেঞ্চার মুভি ‘প্রিন্স অফ পার্সিয়া: দ্য ফরগটেন স্যান্ডস’। আর এখনও পর্যন্ত আমার দেখা আমার পছন্দের সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র হলো ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান সাই-ফাই ছবি ‘জন কার্টার’। এডগার রাইজ বারোজের কালজয়ী লেখনি অবলম্বনে তৈরি, টেলর কিৎসচ ও লিন কলিন অভিনীত এই মুভিটি কখনও-সখনও আবার ‘জন কার্টার অফ মার্স’ নামেও উল্লেখিত হয়ে থাকে।
উল্লেখ করা তিনটি ছবিতেই তিনটি বিষয় কমন – হিরোর লম্বা চুল রয়েছে। সিনেমার নায়ক আল্টিমেট সার্ভাইভার আর ওয়ারিয়র অর্থাৎ যোদ্ধা। সর্বোপরি বিষয় হলো - গন্তব্য নয়, পথিকের আসল পরিচয় তার যাত্রাপথ এবং অসীম গন্তব্যের লক্ষ্যে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে এগিয়ে চলা।
এডগার রাইজ বারোজের লেখা গল্পের প্রতি আমার ছোটো থেকেই আকর্ষণ রয়েছে। নাহ... অল্প বয়সে পড়ার সুযোগ পাইনি। অনেকটা বড়ো হওয়ার পর পড়ার সুযোগ হয়েছে। কারণ, বাবা যেহেতু ওসব কোনওদিন কিনে দেয়নি, তাই আমি সাবলম্বী হওয়ার পর থেকে বই পড়ার নেশাটা ধরেছি অন্তহীন অপেক্ষার পর।
মূল রচনা আর সিনেমার পর্দায় তা যখন ফুটে ওঠে, তার মধ্যে পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ, যিনি পটভূমি রচনা করেন, তা কোনও লেখকের লেখনি অবলম্বনে লিখলেও, নিজের স্বাধীন সত্ত্বার পরিচয় তিনি অবশ্যই দেবেন এবং সিনেমা ব্যাপারটিকে আকর্ষণীয় করে তোলারও একটা বিষয় কাজ করে। হতে পারে, গল্পে পড়ে আমার যেটা সুন্দর লাগছে, চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠছে, আদতে রুপোলি পর্দায় তা দৃষ্টিনন্দন নাও লাগতে পারে।
জন কার্টার মুভিটা আমার ভালো লাগার কারণ হলো কল্প-বিজ্ঞান তার সীমানা ক্রমাগত বিস্তার করে চলে। মানব সভ্যতা এইভাবেই আধুনিক ও উন্নত হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের প্রতি আমাদের মনের টান চিরকালের। লাল মাটির গ্রহের রাজকুমারীকে চোখ ভরে দেখার ইচ্ছে আমার রয়েছে, হোক না তা সিনেমার পর্দায়। প্রিন্সেস ডেজা থরিস যেমন সুন্দরি, তেমনই কুশলী যোদ্ধা আর তার মগজের ধারও তেমন প্রখর। তাঁর সদাজাগ্রত চোখ থেকে মিথিকাল নাইথ রে-ও পার পায় না।
সিনেমার প্লটের যে ব্যাপারগুলি আমার মন কেড়েছে এবার সেগুলি বলি। বিজ্ঞানের যে প্রযুক্তিকে আমরা বুঝতে পারি না, সেটাই আমাদের কাছে ম্যাজিক মনে হয়। যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই জীবন তার অস্বিস্তকে ঠিক টিকিয়ে রাখতে শিখে নেয়। হ্যাঁ, জাহাজ...আলোতে ভর করেও হাওয়ায় ভাসতে পারে জেট গতি নেওয়ার আগে। ঈশ্বর বলে কিছু নাই...তাঁর উপাসক বলে আমরা যাঁদের শ্রদ্ধা করি, তাঁরাই আসলে যাবতীয় গল্পের রচয়িতা এবং পথপ্রদর্শক।
নিজের পরিবারকে হারানোর মর্মবেদনায় জর্জরিত পৃথিবীর এক সাধারণ মানুষের নিজের অজান্তেই অতিপরিচিত ভিনগ্রহে যাত্রা, সেখানের পরিবেশ ও জীবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, যোদ্ধার বর্ম ফের ধারণ করা, উচিতের জন্য লড়াইতে নামা, রাজকুমারীকে মন দেওয়া, সবকিছু পাওয়ার পর ফের সবকিছু হারিয়ে বসা এবং মনের মানুষের কাছে পৌঁছনোর লক্ষ্যে মেডালিয়ন জোগাড়ের জন্য অনবরত প্রয়াস চালিয়ে সফল হওয়া। সিনেমাটি শেষ হয়েও শেষ হয়নি। মেডালিয়ন পেয়ে পাঁচ বছর পর মঙ্গলে জন কার্টার যাত্রা করলেও, তার পরের কাহিনী জানতে ইচ্ছে করে। অনুভূতিটা অনেকটা ছোটো গল্প পড়ে আমরা যেমন নিজের মনে মনেই গল্প রচনা করে নিই, এই সিনেমাটিও একইরকমভাবে আমাকে কল্পনার জাল বোনার অবকাশ দেয়।
জন কার্টার সিনেমাটির পরতে পরতে বিজ্ঞানের ছাপ রয়েছে, যা কল্পনার জগতে নিয়ে গেলেও, মেকী মনে হয় না। আজ না হয় কাল, তা বাস্তবে পরিণত হবেই। কিন্তু, মূল লেখকের ভাবনা-চিন্তার সময় বিচার করলে অভিভূত হতে হয়। আর হ্যাঁ...আরেকজনের কথা উল্লেখ না করলে, তা কখনই পরিপূর্ণতা পাবে না। ভীষণ অদ্ভূত, অথচ দারুণ সুন্দর মঙ্গলের কুকুর উলা। এখানে হোক, কিংবা ভিন গ্রহে - মানুষের বিশ্বস্ত সহচর সর্বদাই বিশ্বস্ত। উলা ছাড়া জন কার্টার কখনই সম্পূর্ণ নয়। অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্সের সূত্র অনুযায়ী সে জন কার্টার অফ আর্থ যতই জন কার্টার অফ মার্স হয়ে উঠে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়ুক না কেন!
কল্প বিজ্ঞানের আমার পছন্দসই আরও ফ্যাক্টর রয়েছে ছবিটিতে। ভিন গ্রহের সবুজ জীব থার্করাও বন্ধু হতে পারে। বন্ধুত্বের ভালোবাসা কখনও কোনও সীমায় বাঁধে না, ঠিক যেমনটি লাল রঙা রাজকুমারীর প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা মানেনি। অন্য কোনও সৌর মণ্ডল থেকে এসে নিজেদের অমরভাবা এবং দেবী ইসের উপাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা থার্ন’রা দীর্ঘজীবী হলেও, তারা অমর নয়। পৃথিবীর মানুষের তৈরি গুলি, তাদের চামড়া ভেদ করে প্রাণু বায়ুকে বিদায় জানিয়ে দিতে পারে। আর হ্যাঁ...উদ্দেশ্য এবং লড়াইয়ের লক্ষ্য যখন উচিতের জন্য হয় – তখন ভাষা না জেনে-বুঝেও ‘ডোটার সোজাট’-এর অর্থ উপলব্ধি করে ফেলতেও কোনও অসুবিধা হয় না।
আর যেটা না বললে নয়... আমি জন কার্টার সিনেমাটি এখনও পর্যন্ত সাতচল্লিশবার দেখেছি। নাহ...বোর হই না। একবারও না। বরং... বারবার ছবিটি আমাকে এক অজানা, অথচ ভীষণ চেনা কল্পনার জগতে নিয়ে যায়।
ঠিক এরকমই একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমি ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ডোরিয়ান গ্রে ছবিটি দেখে পেয়েছিলাম। অস্কার ওয়াইল্ডের একমাত্র উপন্যাস দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে-এর পটভূমির অনুকরণে তৈরি হরোর-ফ্যান্টাসি জঁরের এই ব্রিটিশ সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন বেন বার্নস ও কলিন ফার্থ। ছবিটি যদি না দেখে থাকেন, অবশ্যই দেখবেন। জীবনকে অন্যভাবে দেখতে শিখবেন, বুঝতে শিখবেন। নিজের ভিতরকার আসল মানুষটা এবং তার চাহিদার সীমানাটা উপলব্ধি করতে পারবেন। উপলব্ধি করতে পারবেন, কারও মনের কল্পনা কতোদূর যাত্রা করতে পারে।
দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে (২০০৯):
(ছবি: সৌজন্যে গুগল)
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন