বাবাকে নিয়ে হয়নি বলা যে কথা।
ছেঁড়া লুঙ্গিকে কীভাবে ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে পরতে হয় বাবার কাছ থেকে শিখেছিলাম। অনেক যত্ন করে লুঙ্গি পরতেন বাবা। এক লুঙ্গিতে তিন চার বছর অনায়াসে পার করে দিতেন। ছোটবেলায় বাবার পরনে নতুন লুঙ্গি ঠিক কখন দেখেছি আমার মনে পড়ে না। পূজার আগে পুরোনো পাঞ্জাবি আর পূজায় বিশেষ ধুতি খানা বের করে দিতেন মা। ধোপার বাড়ি ঘুরে এসে সেই কাপড়গুলোই ঝকঝকে পূজার পোশাক হয়ে উঠত।
নিজের জন্য নতুন কাপড়, এটা যেন তিনি ভাবতেই পারতেন না। এটাকে স্রেফ বিলাসিতা আর অনর্থক অর্থ অপচয়ের কাতারেই রাখতেন। আমার বড় বোন ও মা অনেক করে বলতেন বাবাকে, একটা নতুন জামা নেওয়ার জন্য। বাবা কয়েক বছরের পুরোনো কিন্তু দেখতে নতুনের মতো ঝকঝকে জামাগুলো দেখিয়ে বলতেন, এই দেখ আমার কত জামা। টানাটানির সংসারে নিজের জন্য নতুন কাপড় কেনার বিলাসিতা এক দণ্ডও পছন্দ ছিল না বাবার। কিন্তু আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের আপ্যায়ন খরচটা যেন ওনার গায়েও লাগত না। আমাদের শিক্ষকদের তিনি ঠিক ততটুকুই ভালোবাসতেন যতটুকু তিনি আমাদের বাসতেন। এক মাস এই খরচটা বাঁচালে নতুন কাপড় কিনতে কোনো বেগ পেতে হয় না।
একটা ছোট টেবিলের তিনপাশে চেয়ার টেনে আমরা দুই ভাই বোন পড়তাম। মাঝখানে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলত। প্রতিদিন বাবা কেরোসিন কিনতেন অল্প অল্প। দোকানে যাওয়ার আগে বোতলে থাকা তেলগুলো আরেকটি বোতলে জমিয়ে রাখতেন। যদি কোনো দিন তেল কিনতে না পারেন তাহলে জমানো কেরোসিন থেকেই সেই রাতটা পার করিয়ে দিতেন। কেরোসিন সাশ্রয়ের জন্য কুপির যে সুতোটা জ্বলত সেটা টেনে একটু ছোট করে দিতেন মা। যাতে আলোটা ছোট হয়ে দীর্ঘ সময় জ্বলে।
আমাদের টেবিলের হাত পাঁচেক দূরে আরেকটি চেয়ারে বসে থাকতেন বাবা। সেই সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি। আমাদের বিছানায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েই তারপর তিনি বিছানা ধরতেন। শুধুই কী বসে থাকা? কিছুক্ষণ পর পর তিনি গল্প বলতেন। জীবনের গল্প। জীবনে হেরে যাওয়ার গল্প। জয়ের গল্প। মানবতার গল্প। মমতার গল্প। মানুষের গল্প। জীবনে টিকে থাকার গল্প। একাগ্রতার গল্প। অধ্যবসায়ের গল্প। এত গল্প!
জীবনের এমন কোনো শাখা নেই যে শাখার গল্পগুলো বাবার মুখে শোনা হয়নি। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম বাবার গল্পগুলো। আর সেই গল্পের একজন হয়ে যেতাম কখনো কখনো। নিজের অজান্তেই সেই গল্পের আল ধরেই চলতাম আমি অার বোন। কথা শেষে স্বস্থি ফিরে পেয়ে আবার পড়ালেখায় মন দিতাম।
পূর্ণিমার রাতগুলোতে উঠোনে উঠোনে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর পসরা বসতো। সারা বাড়ি গম গম করত, হই হুল্লোড়ে। আমরা থাকতাম পড়ার টেবিলে। বাবা থাকতেন একই জায়গায়। হই চইয়ের মধ্যে আমাদের মনোযোগ ভ্রষ্ট হতে দেখলে বাবা একাগ্রতার গল্প জুড়ে দিয়ে শেষে বলতেন, মনে রেখো, বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে, একা আমি বসে রবো কর্তব্য সাধিতে। তারপর এর ভাবটা সম্প্রসারণ করে বুঝিয়ে দিতেন একাগ্রতার গুরুত্ব। সত্যি সত্যিই এরপর আমরা আর কিছুই শুনতে পেতাম না। ছেলেমেয়ের হই হই কিংবা বিয়ে বাড়ির রই রই কোনো কিছুই এই দুই কানের ত্রিসীমানার হদিসও খুঁজে পেত না।
বাবার অসচ্ছলতা ছিল চাল-ডাল কেনার ক্ষেত্রে। কিন্তু খাতাকলম কেনার সময় কোনো দিন অসচ্ছলতা দেখিনি। এক রিম খাতা। কয়েক ডজন কলম। একবারেই কিনে রাখতেন বাবা। বলে রাখতেন, খাতা-কলম ফুরিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই যেন বলে রাখি। দৃঢ়স্বরে বলতেন, যেভাবেই হোক, উপোস থেকে হলেও তোদের খাতাকলম আমি সংগ্রহ করে রাখবই।
একদিন পড়ার টেবিলের মাঝখানে থাকা কেরোসিন কুপির অবসান হলো। বাবা হাতে করে নিয়ে এলেন একটি হারিকেন। কেরোসিন কুপির কালো ধোয়ায় আমাদের নাকি ক্ষতি হচ্ছে। সেটা ভেবেই হারিকেন নিয়ে এলেন। তাতে বাবার ঝক্কি ঝামেলাই বেড়ে গেল। হারিকেনে তেল বেশি লাগে আবার এর ফিতাটাও কিনতে হয়। তবুও তিনি হারিকেন জ্বালাবেন। হারিকেনের অনেক সুবিধা আমরা পরখ করতে লাগলাম। চাবি দিয়ে হারিকেনের আলো ছোট বড় করা যায়। চোখে আলো না পড়ার জন্য ছোট ছোট কাগজ চিমনিতে আটকে দিলে, চোখ আরাম পেত। ঝড়- বাদলার দিনে হারিকেন নিয়ে বাইরে উঁকি দেওয়া যায়।
বাবা!
৩০ কী ৩৩ বছরের মাথায় আমার বাবা তার বাবাকে হারিয়েছেন। এই লোকটি সংসারের একমাত্র পুরুষ। সংসারের পুরো ঘানিই একাই টেনে নিয়ে যেতে হলো ছেলেটিকে। চাষের জমি দেখাশোনার পর মা-বোনের জীবিকার রসদ যুগিয়ে, নিজের জীবনের রসদ জোগানোর কোনো ফুরসতই যেন মিলত না তার। তবুও পড়ালেখার প্রতি দুর্নিবার আসক্তি এই অদম্য ছেলেটিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শত প্রতিকূলতা পেছনে রেখে হাইস্কুলের গণ্ডি মাড়িয়েছে অার্থিক কারনে অার যেতে পারেনি বহুদূরে। কিন্তু তত দিনে দামামা বেজে ওঠে হানাহানির। ছেলেটিকে একা পেয়ে কিছু লোভী প্রতিবেশী তার জমিজিরাত নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। আর এই বিশৃঙ্খলাই বই-খাতা-কলমের সঙ্গে মিতালি গড়ে তোলা ছেলেটির জীবনে এক ঝোড়ো সন্ধ্যা নেমে আসে।
ছেলেটি একা। এই ঝড়ে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে ছেলেটি। হারতে হারতে জীবনের ঘানি টেনে নিয়ে যায় সামনে। ঝড়ে ঝড়ে রাত আরও গভীর হয় অার কষ্টটাও অারো বেড়ে চলে। অার সেই হলো অামার সুপার হিরো বাবা। অামার সুপার হিরো।
কথা হলো ছেলেটা অাজ ঠিক অাছে তার পরিবার নিয়ে কিন্তু প্রিয় কারো অপেক্ষায় হতাশ।
ছেঁড়া লুঙ্গিকে কীভাবে ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে পরতে হয় বাবার কাছ থেকে শিখেছিলাম। অনেক যত্ন করে লুঙ্গি পরতেন বাবা। এক লুঙ্গিতে তিন চার বছর অনায়াসে পার করে দিতেন। ছোটবেলায় বাবার পরনে নতুন লুঙ্গি ঠিক কখন দেখেছি আমার মনে পড়ে না। পূজার আগে পুরোনো পাঞ্জাবি আর পূজায় বিশেষ ধুতি খানা বের করে দিতেন মা। ধোপার বাড়ি ঘুরে এসে সেই কাপড়গুলোই ঝকঝকে পূজার পোশাক হয়ে উঠত।
নিজের জন্য নতুন কাপড়, এটা যেন তিনি ভাবতেই পারতেন না। এটাকে স্রেফ বিলাসিতা আর অনর্থক অর্থ অপচয়ের কাতারেই রাখতেন। আমার বড় বোন ও মা অনেক করে বলতেন বাবাকে, একটা নতুন জামা নেওয়ার জন্য। বাবা কয়েক বছরের পুরোনো কিন্তু দেখতে নতুনের মতো ঝকঝকে জামাগুলো দেখিয়ে বলতেন, এই দেখ আমার কত জামা। টানাটানির সংসারে নিজের জন্য নতুন কাপড় কেনার বিলাসিতা এক দণ্ডও পছন্দ ছিল না বাবার। কিন্তু আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের আপ্যায়ন খরচটা যেন ওনার গায়েও লাগত না। আমাদের শিক্ষকদের তিনি ঠিক ততটুকুই ভালোবাসতেন যতটুকু তিনি আমাদের বাসতেন। এক মাস এই খরচটা বাঁচালে নতুন কাপড় কিনতে কোনো বেগ পেতে হয় না।
একটা ছোট টেবিলের তিনপাশে চেয়ার টেনে আমরা দুই ভাই বোন পড়তাম। মাঝখানে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলত। প্রতিদিন বাবা কেরোসিন কিনতেন অল্প অল্প। দোকানে যাওয়ার আগে বোতলে থাকা তেলগুলো আরেকটি বোতলে জমিয়ে রাখতেন। যদি কোনো দিন তেল কিনতে না পারেন তাহলে জমানো কেরোসিন থেকেই সেই রাতটা পার করিয়ে দিতেন। কেরোসিন সাশ্রয়ের জন্য কুপির যে সুতোটা জ্বলত সেটা টেনে একটু ছোট করে দিতেন মা। যাতে আলোটা ছোট হয়ে দীর্ঘ সময় জ্বলে।
আমাদের টেবিলের হাত পাঁচেক দূরে আরেকটি চেয়ারে বসে থাকতেন বাবা। সেই সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি। আমাদের বিছানায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েই তারপর তিনি বিছানা ধরতেন। শুধুই কী বসে থাকা? কিছুক্ষণ পর পর তিনি গল্প বলতেন। জীবনের গল্প। জীবনে হেরে যাওয়ার গল্প। জয়ের গল্প। মানবতার গল্প। মমতার গল্প। মানুষের গল্প। জীবনে টিকে থাকার গল্প। একাগ্রতার গল্প। অধ্যবসায়ের গল্প। এত গল্প!
জীবনের এমন কোনো শাখা নেই যে শাখার গল্পগুলো বাবার মুখে শোনা হয়নি। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম বাবার গল্পগুলো। আর সেই গল্পের একজন হয়ে যেতাম কখনো কখনো। নিজের অজান্তেই সেই গল্পের আল ধরেই চলতাম আমি অার বোন। কথা শেষে স্বস্থি ফিরে পেয়ে আবার পড়ালেখায় মন দিতাম।
পূর্ণিমার রাতগুলোতে উঠোনে উঠোনে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর পসরা বসতো। সারা বাড়ি গম গম করত, হই হুল্লোড়ে। আমরা থাকতাম পড়ার টেবিলে। বাবা থাকতেন একই জায়গায়। হই চইয়ের মধ্যে আমাদের মনোযোগ ভ্রষ্ট হতে দেখলে বাবা একাগ্রতার গল্প জুড়ে দিয়ে শেষে বলতেন, মনে রেখো, বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে, একা আমি বসে রবো কর্তব্য সাধিতে। তারপর এর ভাবটা সম্প্রসারণ করে বুঝিয়ে দিতেন একাগ্রতার গুরুত্ব। সত্যি সত্যিই এরপর আমরা আর কিছুই শুনতে পেতাম না। ছেলেমেয়ের হই হই কিংবা বিয়ে বাড়ির রই রই কোনো কিছুই এই দুই কানের ত্রিসীমানার হদিসও খুঁজে পেত না।
বাবার অসচ্ছলতা ছিল চাল-ডাল কেনার ক্ষেত্রে। কিন্তু খাতাকলম কেনার সময় কোনো দিন অসচ্ছলতা দেখিনি। এক রিম খাতা। কয়েক ডজন কলম। একবারেই কিনে রাখতেন বাবা। বলে রাখতেন, খাতা-কলম ফুরিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই যেন বলে রাখি। দৃঢ়স্বরে বলতেন, যেভাবেই হোক, উপোস থেকে হলেও তোদের খাতাকলম আমি সংগ্রহ করে রাখবই।
একদিন পড়ার টেবিলের মাঝখানে থাকা কেরোসিন কুপির অবসান হলো। বাবা হাতে করে নিয়ে এলেন একটি হারিকেন। কেরোসিন কুপির কালো ধোয়ায় আমাদের নাকি ক্ষতি হচ্ছে। সেটা ভেবেই হারিকেন নিয়ে এলেন। তাতে বাবার ঝক্কি ঝামেলাই বেড়ে গেল। হারিকেনে তেল বেশি লাগে আবার এর ফিতাটাও কিনতে হয়। তবুও তিনি হারিকেন জ্বালাবেন। হারিকেনের অনেক সুবিধা আমরা পরখ করতে লাগলাম। চাবি দিয়ে হারিকেনের আলো ছোট বড় করা যায়। চোখে আলো না পড়ার জন্য ছোট ছোট কাগজ চিমনিতে আটকে দিলে, চোখ আরাম পেত। ঝড়- বাদলার দিনে হারিকেন নিয়ে বাইরে উঁকি দেওয়া যায়।
বাবা!
৩০ কী ৩৩ বছরের মাথায় আমার বাবা তার বাবাকে হারিয়েছেন। এই লোকটি সংসারের একমাত্র পুরুষ। সংসারের পুরো ঘানিই একাই টেনে নিয়ে যেতে হলো ছেলেটিকে। চাষের জমি দেখাশোনার পর মা-বোনের জীবিকার রসদ যুগিয়ে, নিজের জীবনের রসদ জোগানোর কোনো ফুরসতই যেন মিলত না তার। তবুও পড়ালেখার প্রতি দুর্নিবার আসক্তি এই অদম্য ছেলেটিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শত প্রতিকূলতা পেছনে রেখে হাইস্কুলের গণ্ডি মাড়িয়েছে অার্থিক কারনে অার যেতে পারেনি বহুদূরে। কিন্তু তত দিনে দামামা বেজে ওঠে হানাহানির। ছেলেটিকে একা পেয়ে কিছু লোভী প্রতিবেশী তার জমিজিরাত নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। আর এই বিশৃঙ্খলাই বই-খাতা-কলমের সঙ্গে মিতালি গড়ে তোলা ছেলেটির জীবনে এক ঝোড়ো সন্ধ্যা নেমে আসে।
ছেলেটি একা। এই ঝড়ে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে ছেলেটি। হারতে হারতে জীবনের ঘানি টেনে নিয়ে যায় সামনে। ঝড়ে ঝড়ে রাত আরও গভীর হয় অার কষ্টটাও অারো বেড়ে চলে। অার সেই হলো অামার সুপার হিরো বাবা। অামার সুপার হিরো।
কথা হলো ছেলেটা অাজ ঠিক অাছে তার পরিবার নিয়ে কিন্তু প্রিয় কারো অপেক্ষায় হতাশ।